আপনার বাচ্চার কি স্কুল রিফিউজ্যাল সমস্যা রয়েছে?

তিতাসের বাবা মা খুশীতে ডগমগ তাদের তিতাসকে কলকাতার এক বিখ্যাত স্কুলে ভর্তি করতে পেরে। তিতাসও খুব খুশী নতুন স্কুলে যাবে বলে। কিন্তু দিন দুয়েক পর থেকেই স্কুলে যাওয়ার প্রতি সাংঘাতিক এক অনীহা এসেছে তার। সকালবেলায় তার স্কুল যাওয়া নিয়ে বাড়ীতে তান্ডবযুদ্ধ চলে প্রতিদিন। শেষ পর্যন্ত তিতাসের কাছে পরাস্ত হয়ে যায় তার মা বাবা। স্কুল কামাই হতে থাকে দিনের পর দিন।
দুশ্চিন্তায় ঘুম চলে গেছে তিতাসের মা বাবার।

সাত বছরের অভিলাষ স্কুলে যেতে খুবই ভালোবাসত। একদিন স্কুলে না গেলেই তার ভীষণ মন খারাপ হয়ে যেত। হঠাৎই তার মধ্যে এক আশ্চর্য পরিবর্তন। স্কুলের না যাওয়ার জন্য সে কোন না কোন অজুহাত দিচ্ছে রোজই… কোনদিন মাথাব্যথা তো কোনদিন বা পেট ব্যথা। প্রথমদিকটায় অভিলাষের মা বাবা ব্যাপারটি বুঝতে পারেননি। তার কিছুদিন পরই বোঝা গেল অভিলাষ স্কুল রিফিউসাল সমস্যায় আক্রান্ত।

আট বছরের মন্জরী হঠাৎই স্কুল যাওয়া নিয়ে অনিচ্ছা প্রকাশ করল। আর তার সাথে আবদার জুড়লো তার মা বাবাকেও বাড়ীর
বাইরে যেতে দেবেনা। এবং সে দাবী এতটাই জোরালো যে তারাও প্রায় ঘরবন্দী হয়ে গেলেন। ক্রমে জানতে পারা গেল কিছুদিন আগে মন্জরী টি.ভি র কোন সিরিয়ালে দেখেছে মা বাবা কাজে বেরিয়ে অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। তারপর থেকেই সেপারেশন অ্যাংজাইটিতে ভুগছিল ছোট্ট মন্জরী। তারই প্রতিফলন হিসেবে দেখা যাচ্ছিল ওর স্কুল রিফিউস্যাল সমস্যা।

স্কুল রিফিউসাল সমস্যা আদপে কী?

অনেকসময় বাচ্চাদের মনে বিভিন্ন রকম
ইমোশন কাজ করে। কখনো বাবা মায়ের সাথে বিচ্ছেদের ভয়, কখনো বা স্কুলসংক্রান্ত কোন সমস্যাকে মোকাবিলা করতে না পারা হতাশা, কখনো বা সোশ্যাল অ্যাডজাস্টমেন্টে অসুবিধে কখনও বা শারীরবৃত্তীয় কারণে বাচ্চা স্কুলে যেতে অনীহা বোধ করে।
বন্ধুদের সাথে ঝগড়া বা মারামারি, নতুন স্কুলের পরিবেশ, টিচারের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে না ওঠা, ক্লাসের কাজ ঠিকমতন করতে না পারা ইত্যাদি স্কুল রিফিউস্যালের সম্ভাব্য কারণ। অনেকসময় বাচ্চারা
যৌনহেনস্থার শিকার হলেও স্কুলে যেতে চায়না।

কিভাবে বুঝবেন আপনার বাচ্চার স্কুল রিফিউস্যাল সমস্যা হয়েছে?

১। সকালে স্কুলের যাবার প্রস্তুতি শুরু হতেই অনেক সময় বাচ্চারা প্রচন্ড জেদ বা কান্নাকাটি করতে থাকে। অনেকসময় দেখা যায় ঘুম থেকে উঠেই স্কুলে না যাবার বায়না করছে।

২। অনেকসময় বাচ্চারা বাবা মায়ের কাছে কাকুতি মিনতি করে স্কুলে না যাবার জন্য।

৩। কখনো বা ওরা মিথ্যে অজুহাত দেখাতে শুরু করে। কখনো পেট বা মাথা ব্যথা, বমি এসব বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে স্কুলে না যাবার চেষ্টা করে।
৪। কিছু কিছু বাচ্চার মধ্যে আবার প্রচন্ড নার্ভাসনেস কাজ করে ওদের মধ্যে। হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া বা প্রচন্ড ঘাম হওয়া, এসব লক্ষণ দেখা যায় ওদের মধ্যে। কিছু কিছু সময় ওরা নিজেরাই নিজেদের আঘাত করতে থাকে।
৫। লম্বা ছুটির পর স্কুল খুললে বা স্কুলে নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হলে বাচ্চাদের মধ্যে স্কুল রিফিউস্যালের সমস্যা বাড়তে থাকে।

কিভাবে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব?

বাচ্চাদের স্কুল রিফিউস্যাল সমস্যা কিন্তু একেবারেই সোজা ব্যাপার নয়। সঠিক পদক্ষেপ না নিলে বাচ্চার পরবর্তী জীবনে অনেক সমস্যা আসতে পারে। তাই শান্তভাবে পজিটিভ পেরেন্টিং র মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে।

১। বাচ্চার সাথে খোলামনে কথা বলুন। যাতে নির্ভয়ে ও নিশ্চিন্তে ও আপনাকে সব কিছু বলতে পারে। ওকে ক্রমাগত আশ্বাস দিন যে আপনি ওর পাশে সব সময় আছেন। কথা বলার সময় মোবাইল ফোন বা ল্যাপটপ কাছাকাছি না থাকাই ভালো। এতে কথা বলা বিঘ্নিত হতে পারে। এই সময় নিজের মনকেও শান্ত রাখতে হবে।

২। বাচ্চার সাথে স্কুল সংক্রান্ত বিভিন্নরকম পজিটিভ আলোচনা করুন।
নিজের ছোটবেলার স্কুলের অভিজ্ঞতাও শেয়ার করতে পারেন ওর সাথে। এর ফলে ওর মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরী হবে।

৩। অনেকসময় বাচ্চারা স্কুলের নিয়মকানুনে বন্দী থাকতে চায়না। বাড়ীতে দেরী করে ঘুম থেকে ওঠা, ইচ্ছেমতন টিভি দেখা বা গেম খেলার অভ্যাস অনেকসময়ই স্কুল রিফিউস্যালের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই বাড়ীতে বাচ্চার একটা নির্দিষ্ট রুটিন থাকা ভীষণ জরুরি।স্কুলে না গেলে বাড়ীতে ওই সময় কোনভাবে টিভি দেখা বা খেলা করাকে প্রশ্রয় দেবেন না। ওই সময় ওকে পড়াশোনার কাজে ব্যস্ত রাখুন। যখনই ও দেখবে বাড়ীতে থাকা মোটেই মজার নয়, তখন আবার ও স্কুল যেতে চাইবে।

৪। স্কুলের প্রতি আগ্রহ গড়ে তুলতে প্রিটেন্ড গেম খেলতে পারেন। অনেকসময় বাচ্চারা ক্লাসে বসে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ করতে পারে না। ক্লাস ঠিকমতন ফলো না করতে পারলে ওরা উৎসাহও পায়না। তাই বাড়ীতে খেলাচ্ছলে সেই অভ্যাস করানোর বিশেষ প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে একটি কেস স্টাডির উল্লেখ করি।
পাঁচ বছরের শিন্জিনি সদ্য নার্সারী থেকে ক্লাস ওয়ানে উঠেছে। ক্লাসে পড়ার চাপ বেড়েছে এবং ম্যাডামরাও খেলাচ্ছলে পড়ানোর মাত্রা কমিয়েছেন। এর ফলে শিন্জিনির মন বিষণ্ণ হয়ে যায়। স্কুলে যাবার প্রতি তার আগ্রহও কমতে থাকে। ক্লাসে ম্যাডাম ব্যাপারটি লক্ষ্য করে ওকে বেশীমাত্রায় দায়িত্ব দেওয়া , প্রশংসা করা শুরু করেন। ক্রমে পরিবর্তন হতে থাকে ছোট্ট শিন্জিনির মন। এখন সে আবার আগের মতই উৎসাহ বোধ করে স্কুল যেতে।

৫। স্কুল কর্তৃপক্ষ বা ক্লাস টিচারের সাথে বিশদে এ বিষয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে তারা এ বিষয়ে যখাযথ ব্যবস্থা নিতে পারবেন।

৬। অনেকসময় বাবা মায়ের থেকে কিছুক্ষণের জন্য বাচ্চা বিচ্ছিন্ন থাকলে তাদের মধ্যে সেপারেশন অ্যাংজাইটির জন্ম নেয়। তখন বাচ্চা ডিপ্রেশনেও চলে যায়। এ সব ক্ষেত্রে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা বিশেষভাবে প্রয়োজন।

৭। বাচ্চা স্কুল যাওয়ার সময় বাড়ীর পরিবেশ শান্ত রাখার চেষ্টা করুন। অনেকসময় স্কুল যাওয়ার ঠিক আগে বাড়ীতে অশান্তিমূলক কিছু ঘটনা ঘটলে বাচ্চার সরল মন উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। অতিরিক্ত টেনশনের জন্য সে আর স্কুলে যেতে চায়না।

৮। স্কুল রিফিউস্যাল সমস্যায় অনেক রিওয়ার্ড সিস্টেম খুব কার্যকরী হয়। বাচ্চাকে বোঝাতে হবে স্কুল যাওয়া মানে নিজের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার একটা বড় ধাপ। সেটা ভালোভাবে করতে পারলে তাকে মাঝে মাঝে রিওয়ার্ড দেওয়া প্রয়োজন। তাহলে সে আরো উৎসাহ পাবে।

বাচ্চাদের স্কুল রিফিউস্যাল সমস্যা কাটিয়ে তুলতে অভিভাবকদের তাই ধৈর্য। মারধোর বা বকাঝকা নয়, উপযুক্ত পেরেন্টিং পদ্ধতির মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।

Note: The above text is taken from the Bengali parenting book “Ishkuler Mushkil Ashan” (published from Dey’s Publishing) written by Parenting Consultant Payel Ghosh.